হিমালয় প্রতিনিধিঃ
শ্রীলংকায় সোমবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর আরও সংঘর্ষ ঠেকাতে ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে দেশটির সরকার সহিংসতাকারীদের দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দিয়েছে।
মঙ্গলবার দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যাদেরই সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করতে ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি লুটপাট করতে দেখা যাবে তাদের দেখা মাত্র গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। খবর এএফপির।
তাছাড়া পুলিশ ও সেনাবাহিনীকেও অনেক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
বলা হয়েছে সেনাবাহিনী ও পুলিশ কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়া যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে। তাছাড়া সেনাবাহিনী কাউকে আটক করলে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার আগে ২৪ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় নিজেদের জিম্মায় রাখতে পারবে।
এমনকি পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে সন্দেহভাজন যে কারও বাড়ি ও গাড়ি তল্লাশি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সোমবার পুরো শ্রীলংকায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন।
এদিন সদ্যই পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজপাকসের সমর্থকরা কলম্বোতে সরকার বিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয়। তারা লাঠি দিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর আঘাত করে।
এরপরই পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে এ সংঘর্ষ। স্থানীয় সময় রাতে বিক্ষুদ্ধ জনতা সরকার দলীয় রাজনীতিবীদদের বাড়িতে হামলা ও আগুন ধরিয়ে দেয়। তাছাড়া রাজাপাকসের সরকারি বাড়িতেও হামলা করার চেষ্টা চালায়।
সংবাদ সংস্থা এএফপি আরও জানিয়েছে, রাতের বেলা কলম্বো বিমানবন্দরের রাস্তা অবরোধ করে জনতা। জানা গেছে রাজাপাকসেপন্থি কেউ যেন দেশ ছেড়ে না পালাতে পারে সেজন্য বিমানবন্দর ঘেরাও করেছিলেন তারা।
পুলিশ জানিয়েছে, সোমবারের সংঘর্ষে আটজন প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া আরও ২২৫ জন আহত হয়েছেন।
এদিকে সোমবার মাহিন্দা রাজাপাকসের সরকারি বাসভবনে উত্তেজিত জনতা হামলা করার পর তাকে হেলিক্প্টারে করে উদ্ধার করে নিয়ে যায় সেনাবাহিনী।
চামাল পোলওয়াত্তে নামে একজন আন্দোলনকারী জানান, প্রেসিডেন্টকেও পদত্যাগ করতে হবে। তিনি পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
গদি টললে ঠাটঠমকও যায়। পলকে পালটে যায় চারপাশ। একসময় যাদের চোখের ইশারায় উঠত-বসত গোটা শ্রীলংকা, ভয়-শ্রদ্ধায় নুইয়ে যেত সাধারণের মাথা, রাস্তায় রাস্তায় জনরোল উঠত একনজর দেখার-সেই তারাই পড়ে আছে পথে। মার খাচ্ছে, ভয়ে পালাচ্ছে। লংকানদের চক্ষুশূল সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের দলের মন্ত্রী-এমপিদের দশা এখন এমনই।
থুতু করছে সবাই। কপালে জুটছে রামধোলাই। ধরে ধরে পেটাচ্ছে জনগণ। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। সোমবার রাত থেকে শুরু করে মঙ্গলবারও এ দৃশ্য চোখে পড়েছে রাজধানীসহ দ্বীপের আনাচে-কানাচে।
মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন সোমবার বিকালে। এর পরপরই শুরু হয় লঙ্কাকাণ্ড। প্রথমে মাহিন্দা সমর্থকরা তেড়ে আসেন বিক্ষোভকারীদের দিকে। পালটা জবাব দিতে ছাড় দেয়নি সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরাও। শুধু সমর্থকদের মেরেই ক্ষান্ত হয়নি জনগণ, হামলা চালায় মন্ত্রী এবং এমপিদের বাড়িতেও।
গণধোলায়ও খেয়েছেন কয়েকজন এমপি-মন্ত্রী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যম ও স্থানীয় অনলাইন পত্রিকাগুলোয় এ দৃশ্যগুলো চোখে পড়েছে। নাম-পরিচয় সিংহলি ভাষায় লেখা হওয়ায় তা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে গণমাধ্যমের বরাতে এ ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। গণপিটুনির শিকার মন্ত্রীদের ছবি-ভিডিওর পাশাপাশি সন্ধান না পাওয়া মন্ত্রীদের ছবি লিফলেট আকারে ছড়িয়ে পড়েছে সেখানে। এক ভিন্ন ধরনের ‘সন্ধান চাই’ লিফলেট এটি।
মালওয়ানা অঞ্চলে বাসিল রাজাপাকসের একটি বাড়ি আছে বলে চলছিল কানাঘুষা। সেই বাড়িও রেহাই পেল না লংকানদের হাতে। ক্ষুব্ধ লংকানদের আগুনে জ্বলছে সেই বাড়ি। এমপি কুমারা ওয়েলগামা তার গাড়িতে যাত্রীকালীন হয়েছেন আক্রমণের শিকার। সোমবার সন্ধ্যায় মাকুম্বা এলাকায় ঘটে ঘটনাটি। তাৎক্ষণিক হাসপাতলে ভর্তি করা হয় তাকে। সেখানে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়। অপরদিকে কাটুনায়াকে ফ্রি ট্রেড জোনে (এফটিজেড) একদল যুবক শ্রীলংকার বন্দরনায়েকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশপথ আটকে দেন। ক্ষমতায় থাকা এবং পদত্যাগ করা মন্ত্রীদের শ্রীলংকা ছেড়ে পালানোয় বাধা দিতে এই অভিনব পন্থা বের করেছেন তারা। তাদের দেখাদেখি বিমানবন্দরের ভেতরে শ্রীলংকান ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তৈরি করেন মানবদেওয়াল। সরকারদলীয় জোটের এমপি-মন্ত্রীদের দেশত্যাগ করা থেকে রুখতে এভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছেন তারা।
এছাড়াও শ্রীলংকার প্রথম সারির মন্ত্রীদের বাসায়ও হয় হামলা। শ্রীলংকা পদুজানা প্যারামুনায় (এসএলপিপি) প্রায় ১৫ জন রাজনীতিকের বাড়িতে হয় হামলা। দেওয়া হয় আগুন। তাদের মধ্যে অনেকেই দায়িত্ব পালন করেছেন সরকার দলের সংসদ-সদস্য হিসাবে। তারা হলেন বান্দুলা গুনাওয়ারদেনা, প্রসান্না রানাতুঙ্গা, চান্না জায়াসুমানা, কোকিলা গুনাওয়ারদেনা, অরুনদিকা ফারন্যান্দো, নিমল লানজা, টিসসা কুত্তিআরাচ্ছি, কনাক হেরাথ, প্রতিভা ওয়ান্নিআরাচ্ছি, গামিনি লৌগে ও কাঞ্চনা উজেসেকেরা।
সোমবার রাতেই হামবানটোটা জেলার মেদামুলানা এলাকায় অবস্থিত রাজাপাকসেদের পৈতৃক বাড়িতে হামলার একপর্যায়ে লাগিয়ে দেওয়া হয় আগুন। মাহিন্দার কুরুনেগালার বাসস্থানেও দেখা যায় একই চিত্র। দামি লাম্বরগিনি গাড়িকেও ছাড় দিল না কেউ। গাড়ি-বাড়িতে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। এ ঘটনার সময় নিজ বাড়িতেই ছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। ভোরে সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল সেখান থেকে উদ্ধার করেন তাকে। এরপর নৌবাহিনীর একটি ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। বেলা গড়ালে জানাজানি হলে ঘাঁটির সামনেও পৌঁছে যান বিক্ষোভকারীরা। ঘিরে রাখেন পুরো এলাকা।
Leave a Reply